বাংলাদেশ, সোমবার, অক্টোবর ২৭, ২০২৫

মহাবিশ্ব: সময়, স্থান ও রহস্যের অসীম প্রান্তর

NewsPaper

NewsPaper

প্রকাশিত: ০৯ আগস্ট, ২০২৫, ০১:৫০ অপরাহ্ণ

মহাবিশ্ব: সময়, স্থান ও রহস্যের অসীম প্রান্তর

মানুষ যখন প্রথমবার রাতের আকাশের দিকে তাকায়, তখনই শুরু হয় বিস্ময়ের ইতিহাস। নক্ষত্রের আলো, চাঁদের রূপ, উল্কাপাতের ঝলক কিংবা দূরে কোথাও নীলাভ নীহারিকার সৌন্দর্য; সবই মানুষের মনে এক অনন্ত প্রশ্ন জাগিয়েছে: আমরা কোথা থেকে এলাম, আমাদের চারপাশের এই বিশালতা কী, আর এর শেষ কোথায়?
আমরা যা দেখি, শুনি বা অনুভব করি- সবই এক বিশাল প্রেক্ষাপটের ক্ষুদ্র অংশ। সময় ও স্থানের এই অসীম ক্ষেত্রকেই আমরা মহাবিশ্ব বলে জানি।


অসীমতার ধারণা


অসীমতার ধারণা বোঝা মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমাদের পৃথিবী সীমিত, জীবন সীমিত, কিন্তু মহাশূন্যের বিস্তার কল্পনার বাইরে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দৃশ্যমান অংশের বাইরে রয়েছে এমন সব অঞ্চল যেখানে আলোও এখনো পৌঁছায়নি। সেই অদৃশ্য অংশের খবর আমরা হয়তো কখনোই জানতে পারব না।
একটি তুলনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে: যদি আমাদের গ্যালাক্সি ‘মিল্কিওয়ে’কে একটি বালুকণার মতো ধরা হয়, তবে এক বিশাল সমুদ্রতট হলো সমগ্র দৃশ্যমান মহাবিশ্ব। আর সেটি কেবল দৃশ্যমান অংশ, অদৃশ্য অংশ হয়তো আরও অসংখ্য গুণ বড়।


জন্মের গল্প: বিগ ব্যাং


প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে সবকিছু শুরু হয় এক অদ্ভুত ঘটনায়: বিগ ব্যাং। এর আগে সময়, স্থান, পদার্থ বা শক্তি কিছুই ছিল না। এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দুতে অসীম শক্তি ও তাপ কেন্দ্রীভূত ছিল। হঠাৎ করে সেই বিন্দু বিস্ফোরিত হয়ে প্রসারণ শুরু করে।
প্রথম এক সেকেন্ডে তাপমাত্রা এত বেশি ছিল যে মৌল তৈরি সম্ভব হয়নি। কয়েক মিনিট পরে তাপমাত্রা কমে আসে, এবং হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মতো হালকা মৌল তৈরি হয়। কয়েকশো কোটি বছর পরে এই মৌলগুলো থেকে জন্ম নেয় প্রথম নক্ষত্র। তাদের ভেতরের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় তৈরি হয় ভারী মৌল, যা পরে গ্রহ, উপগ্রহ ও জীবনের ভিত্তি হয়।


মহাবিশ্বের উপাদান ও কাঠামো


বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, যা আমরা চোখে দেখি তা সমগ্রের মাত্র ৫%। বাকি অংশ হলো:

  • ডার্ক ম্যাটার (২৭%) – অদৃশ্য পদার্থ, যা আলো বিকিরণ করে না কিন্তু মহাকর্ষের মাধ্যমে অন্যান্য বস্তুকে প্রভাবিত করে।

  • ডার্ক এনার্জি (৬৮%) – রহস্যময় শক্তি, যা মহাবিশ্বের প্রসারণকে ক্রমাগত ত্বরান্বিত করছে।

দৃশ্যমান অংশের ভেতরে আমরা পাই:

  1. গ্যালাক্সি – কোটি কোটি নক্ষত্র, গ্যাস, ধূলিকণা ও ডার্ক ম্যাটারের সমষ্টি। আমাদের সৌরজগত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত।

  2. নক্ষত্র – শক্তি ও আলো উৎপন্ন করে, যা গ্রহগুলোর জন্য জীবনধারণের সম্ভাবনা তৈরি করে।

  3. গ্রহ ও উপগ্রহ – কঠিন বা গ্যাসীয় পিণ্ড, যারা নক্ষত্রের চারপাশে ঘোরে।

  4. নীহারিকা – গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ, যেখানে নতুন নক্ষত্র জন্ম নেয়।


বিস্তারের রহস্য


দূরবর্তী গ্যালাক্সির আলো বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, সবকিছু একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর মানে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। আর ডার্ক এনার্জি এই প্রসারণের গতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই প্রসারণের ভবিষ্যৎ নিয়ে কয়েকটি তত্ত্ব আছে:

  • বিগ ক্রাঞ্চ – একসময় প্রসারণ থেমে গিয়ে সবকিছু আবার সংকুচিত হবে।

  • হিট ডেথ – প্রসারণ অনন্তকাল চলবে, নক্ষত্রগুলো নিভে যাবে, এবং একসময় সবকিছু শূন্যতায় মিলিয়ে যাবে।

  • বিগ রিপ – প্রসারণ এত দ্রুত হবে যে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ, এমনকি পরমাণুও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।


মানুষের অনুসন্ধান


মানুষ সবসময়ই কৌতূহলী ছিল। গুহাচিত্রের যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক মহাকাশযান পর্যন্ত, আমরা আকাশের রহস্য জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

  • দূরবীন – গ্যালিলিওর হাত ধরে প্রথম আধুনিক পর্যবেক্ষণ শুরু।

  • স্পেস টেলিস্কোপ – হাবল, জেমস ওয়েবের মতো দূরবীন আমাদের অতীতের আলো দেখাচ্ছে।

  • মহাকাশযান – ভয়েজার, নিউ হরাইজনস, পারসিভারেন্স রোভার; সবই দূর গ্রহ ও চাঁদের তথ্য দিচ্ছে।

আজ আমরা এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করছি, দূরের গ্যালাক্সির ছবি তুলছি, এমনকি মহাবিশ্বের প্রথম আলোর প্রতিচ্ছবিও ধারণ করতে পারছি। কিন্তু প্রতিটি উত্তর নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।


দর্শন ও অস্তিত্বের প্রশ্ন


বিজ্ঞান মহাবিশ্বের কাঠামো ও ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু কেন এটি আছে, সেই প্রশ্ন এখনো উন্মুক্ত। আমাদের অস্তিত্ব কি কেবল এক আকস্মিক ঘটনার ফল, নাকি এর পেছনে রয়েছে কোনো গভীর অর্থ?
অনেক দার্শনিক মনে করেন, আমরা যখন এই অসীম প্রেক্ষাপটে নিজেদের স্থান বুঝতে পারি, তখন জীবন ও মানব সভ্যতার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়।


উপসংহার

মহাবিশ্ব শুধু একটি বৈজ্ঞানিক সত্তা নয়, এটি আমাদের কল্পনা, চিন্তা ও কৌতূহলের প্রতীক। আমরা সবাই এর ক্ষুদ্রতম কণার মতো, তবুও আমাদের অনুসন্ধিৎসা এই অসীমতাকে বোঝার পথে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো একদিন আমরা এর গভীর রহস্য উন্মোচন করব, কিন্তু সেই যাত্রাই মানবতার সবচেয়ে মহৎ অর্জন।